প্রতিদিন সকালে হাজারো মানুষ ঘুম থেকে ওঠে একটি চাকরির আশায়। কেউ পরীক্ষা দিচ্ছে, কেউ ইন্টারভিউ দিচ্ছে, কেউ আবার অভিজ্ঞতার অপেক্ষায় বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর লক্ষাধিক তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বের হচ্ছে, কিন্তু তাদের একটি বড় অংশের ভাগ্যে জোটে না কাঙ্ক্ষিত চাকরি। অন্যদিকে, আমাদের দেশে এমন অনেক উদ্যোক্তা বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আছেন, যারা দুই থেকে পাঁচজন মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করে ফেলেছেন শুধুমাত্র তাদের উদ্যম আর সঠিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। প্রশ্ন হচ্ছে— আপনি কোন পক্ষের মানুষ হতে চান? আপনি সারাজীবন চাকরির পেছনে ছুটবেন, না কি নিজেই এমন কিছু গড়বেন যেখানে অন্যরা আপনার কাছে চাকরি চাইবে?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) এর ২০২৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী প্রায় ৭ কোটি ৪০ লাখ, এর মধ্যে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ (যদিও প্রক্রিতপক্ষে এই সংখ্যা অনেক বেশী) । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, দেশের প্রায় ৪০% তরুণ উচ্চশিক্ষিত বেকারদের একটি বড় অংশ চাকরির জন্য অপেক্ষা করছে, অথচ তাদের অনেকের মধ্যেই এমন দক্ষতা বা চিন্তাভাবনা রয়েছে যা দিয়ে তারা নিজের একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগ দাঁড় করাতে পারতো।
উদ্যোক্তা হওয়া মানে শুধু নিজের জন্য কিছু করা নয়, এটি সমাজ, অর্থনীতি ও দেশের জন্যও অবদান রাখার একটি পথ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত জোগান দিয়ে থাকে। অথচ অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখে কেবল চাকরি পাওয়ার পথ। কেউ শেখায় না কীভাবে ব্যবসা করতে হয়, কিভাবে ঝুঁকি নিতে হয়, কীভাবে নতুন আইডিয়াকে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তা গবেষক টিনা সিলিগ বলেন, “আমরা সন্তানদের বলি ‘চাকরি খুঁজো’, কিন্তু বলি না ‘সমস্যা খোঁজো’ — কারণ সমস্যার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে ব্যবসার সুযোগ।” এই কথাটি বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি প্রযোজ্য, কারণ এখানে প্রতিদিনকার জীবনে এমন হাজারো সমস্যা রয়েছে যার সমাধান দিয়ে একটি ভালো উদ্যোগ গড়া সম্ভব।
প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের প্রসার বাংলাদেশে একটি বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৩ কোটিরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, আপনি যদি অনলাইনে একটি ছোট ব্যবসাও শুরু করেন— আপনার সম্ভাব্য গ্রাহক লক্ষ লক্ষ। যারা এখন ইউটিউব চ্যানেল চালাচ্ছেন, ডিজিটাল মার্কেটিং করছেন, হোম-মেইড প্রোডাক্ট বিক্রি করছেন, এমনকি গ্রামে বসে ফ্রিল্যান্সিং করছেন— তারাও কিন্তু উদ্যোক্তা। তারা শুধু নিজের পকেটই ভরাচ্ছেন না, অন্যদেরও দিচ্ছেন কাজের সুযোগ।
“চাকরি হলো নিরাপত্তা, কিন্তু উদ্যোগ হলো স্বাধীনতা।” — এটি শুধু একটি উদ্ধৃতি নয়, এটি একটি মনোভাবের প্রকাশ। চাকরিতে আপনি সীমাবদ্ধ, আপনার বেতন, ছুটি, পদোন্নতি সবকিছু নির্ধারিত। কিন্তু আপনি যদি উদ্যোগ নেন, তাহলে আপনি স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা পান, নিজের শর্তে কাজ করার সাহস পান।
বাংলাদেশে হাজারো উদ্যোক্তার সাফল্যগাঁথা আছে যারা খুব সাধারণভাবে শুরু করেছিলেন। বাগেরহাটের একজন যুবক গরুর দুধ দিয়ে শুরু করেছিলেন দই বিক্রি, আজ তার কারখানায় কাজ করে ২০ জন। চট্টগ্রামের এক তরুণ ‘গার্মেন্টস রিজেক্টেড’ জামা-কাপড় বিক্রি শুরু করে এখন প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা আয় করে, সাথে দিয়েছে আরও পাঁচজনকে চাকরি। ই-কমার্স, এগ্রো-বিজনেস, ফুড প্রসেসিং, ডেলিভারি সার্ভিস— এমন অনেক খাতে শুধু একটি আইডিয়া ও বাস্তব চাহিদাকে মাথায় রেখে অনেকে সফল হয়েছেন।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষণা বলছে, ২০৪০ সালের মধ্যে বর্তমান সময়ের ৪০% চাকরি অটোমেশনের মাধ্যমে চলে যেতে পারে। রোবট, এআই, সফটওয়্যার— সবকিছুই যেভাবে উন্নত হচ্ছে, সেখানে চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু যিনি উদ্যোগের মাধ্যমে ভ্যালু তৈরি করছেন, তার স্থান নেওয়া সহজ নয়। কারণ, একজন উদ্যোক্তা শুধু শ্রম দেন না, তিনি সমাধান দেন, নেতৃত্ব দেন, এবং সমাজে প্রভাব ফেলেন।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের এসএমই খাত দেশের জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান রাখে এবং প্রায় ৮৫ শতাংশ কর্মসংস্থান তৈরি করে। অথচ আমরা এখনও শিক্ষার শুরু থেকেই শেখাই— "ভালো রেজাল্ট করো, একটা ভালো চাকরি পাবে।" কেউ শেখায় না— "ভালো চিন্তা করো, একটা ভালো উদ্যোগ তৈরি করো।" এই মানসিকতা পরিবর্তনের সময় এখনই।
চাকরি খারাপ নয়। সৎ চাকরি গর্বের বিষয়। কিন্তু চিন্তা করতে হবে— আপনি সারাজীবন অন্যের সিদ্ধান্তে নির্ভর করবেন, নাকি নিজেই সিদ্ধান্তদাতা হবেন? আপনি কবে ছুটি নেবেন, কবে অফিস যাবেন, কত টাকা আয় করবেন— এসব কি সবসময় অন্য কেউ ঠিক করে দেবে, নাকি আপনি নিজেই নিজের নিয়তি গড়বেন?
আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস বলেছিলেন, “আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ছিল— আমি চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু আমি ভাবলাম, যদি আমি ৮০ বছর বয়সে গিয়ে ফিরে তাকাই, তাহলে কি আমি অনুতপ্ত হবো? যদি আমি চেষ্টা না করি, তাহলে হ্যাঁ। কিন্তু যদি চেষ্টা করি এবং ব্যর্থ হই, তাহলেও অনুতপ্ত হবো না।” — আমাদের দেশের যুব সমাজের মধ্যেও এই সাহসী মনোভাব গড়ে তোলার সময় এসেছে।
আজ যদি আপনি সিদ্ধান্ত নেন— আপনি নিজে কিছু শুরু করবেন, তাহলে আপনি চাকরির বাজারে আরেকজন প্রতিযোগী হবেন না, বরং আপনি হবেন একজন সম্ভাব্য নিয়োগদাতা। আপনি হবেন সমস্যা সমাধানকারী। আপনি হবেন একজন রোল মডেল।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু করে ইউএনডিপি, আইএফসি, বিআইটিএম— অনেক প্রতিষ্ঠান এখন তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ, বিনিয়োগ ও মেন্টরিং সুবিধা দিচ্ছে। আপনি যদি জানতে চান, আপনি জানতেই পারবেন। আপনি যদি আগ্রহ দেখান, সহযোগিতা পেতেই পারেন।
যদি আপনি আজ বেকার থাকেন, তাহলে হয়তো আপনি ভাবছেন— “আগে একটা চাকরি হোক, তারপর দেখা যাবে।” কিন্তু আপনি আজ থেকেই নিজের মধ্যে সেই মানসিক প্রস্তুতি নিতে পারেন— “আমি নিজেও কাজ তৈরি করতে পারি, শুধু খোঁজটা নিতে হবে নতুনভাবে।” ছোট পরিসরে শুরু করুন, নিজের দক্ষতা বুঝুন, শেখার জন্য সময় দিন— সময়ের ব্যবধানে আপনি নিজেকে বদলাতে পারবেন।
আসলে আপনি চাইলে চাকরি করতে পারেন, কিন্তু সেটি যেন হয় আপনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়, বরং একটি ধাপ মাত্র। আপনার শেষ লক্ষ্য হওয়া উচিত— এমন কিছু গড়া যেখানে আপনি নিজের পাশাপাশি অন্যের ভবিষ্যৎ গড়তে পারেন। আপনি শুধু চাকরি খুঁজবেন না— আপনি হবেন সেই ব্যক্তি যার কাছে অন্যরা চাকরির জন্য আসবে। আপনি হবেন একজন নির্মাতা, নেতৃত্বদানকারী, এবং সমাজের পরিবর্তনের অংশ।
চাকরি করবেন নাকি চাকরি দিবেন— এই সিদ্ধান্তটাই ভবিষ্যতের চেহারা বদলে দেবে।
এ জাতীয় আরো খবর..