খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার এবং সচিব মাসুদুল হাসান উভয়েই এতটা
বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন যে, কোনোই নিয়মনীতি মানছেন না। আলী ইমাম মজুমদার এ
মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছেন গত ১০ নভেম্বর এবং মো. মাসুদুল
হাসান সচিব পদে যোগ দিয়েছেন এর এক মাস আগে ২ অক্টোবর, ২০২৪। উভয়ে এ
মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েই শুরুতে আখের গোছানোর কাজে নেমে পড়েন। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হবে। সেই হিসেবে এ সরকারের মেয়াদ আর বেশিদিন নেই। এদিকে সচিব
মাসুদুল হাসানের চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে বছর শেষ হওয়ার আগেই। ফলে উভয়েই
অনিয়ম-দুর্নীতি ও আখের গোছানোর কাজে অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন এখন। কোনোই
নিয়মনীতি মানছেন না। খাদ্য অধিদপ্তরের যেসব কর্মকর্তা নিয়ম অনুযায়ী
পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্য নন, সুনির্দিষ্ট অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাদের
বসিয়েছেন পদোন্নতির পদে। অন্যদিকে পদোন্নতির যোগ্য কর্মকর্তাকে পদোন্নতি
দিচ্ছেন না। অধিদপ্তরের ৭টি পরিচালক পদের মধ্যে দুটিতেই চলতি দায়িত্বে
পদায়নে রাখা হয়েছে এমন দুই কর্মকর্তাকে, যারা দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মের
কারণে এখন সাসপেন্ড অথবা ওএসডি থাকার কথা। এদিকে এসএসবির সুপারিশ করা এবং
প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদিত পদোন্নতির নথিও আটকে রেখেছেন দীর্ঘ চার মাসেরও
বেশি সময় ধরে। যার নজির খাদ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরে তো নেই-ই এমনকি
সরকারের অন্য কোনো দপ্তরেও নেই, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
মো. তাজল ইসলাম,
বর্তমানে যিনি চলতি দায়িত্বে খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিদর্শন, উন্নয়ন ও
কারিগরি সেবা বিভাগ) এর পদে আছেন- একজন শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা
হিসেবে চিহ্নিত। নারায়ণগঞ্জসহ ইতিপূর্বে যেসব কর্মস্থলে পদায়নে ছিলেন
প্রত্যেকটি কর্মস্থলেই দুর্নীতির কারণে সমালোচিত হয়েছেন। অনেক অপ্রীতিকর
ঘটনাও ঘটেছে তাকে নিয়ে, যার নজির গোটা খাদ্য বিভাগে আর নেই। এই শীর্ষ
দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে অবৈধভাবে চলতি দায়িত্বে অধিদপ্তরের পরিচালক পদে
রাখার বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়েই প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদিত এসএসবির
সুপারিশের গত ১৮ মে’র চিঠির কার্যকারিতা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করেনি খাদ্য
মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-১ শাখার উপসচিব মো.
তৌহিদ বিন হাসান স্বাক্ষরিত “বিসিএস (খাদ্য) ক্যাডারের খাদ্য অধিদপ্তরের
পরিচালক (গ্রেড-৩) পদে পদোন্নতি” বিষয়ের গত ১৮ মে’র উক্ত চিঠিতে বলা হয়েছে,
“উপর্যুক্ত বিষয় ও সূত্রোক্ত স্মারকের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে,
সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের ৮ মে, ২০২৫ তারিখে ২০২৫ সালের ১৫তম সভার
নিম্নবর্ণিত সুপারিশ মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ১৭ মে ২০২৫ তারিখে সদয় অনুমোদন
করেছেন:”
চিঠিতে যে দু’জনের নাম উল্লেখ করা হয় (অর্থাৎ প্রধান উপদেষ্টা
যাদের পদোন্নতি অনুমোদন করেছেন) তারা হলেন বিসিএস (খাদ্য) সাধারণ এর মো.
আব্দুস সালাম (০২১৫২), পরিচালক (চ.দা.) সরবরাহ, বণ্টন ও বিপণন বিভাগ, মূল
পদ: অতিরিক্ত পরিচালক, খাদ্য অধিদপ্তর, ঢাকা। এবং বিসিএস (খাদ্য) কারিগরি
এর মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ খান শিবলী (০৩০৪৩), সাইলো অধীক্ষক, ময়মনসিংহ স্টিল
সাইলো, ময়মনসিংহ। এই দ’ুজন কর্মকর্তাকে পরিচালক (গ্রেড-৩) পদে পদোন্নতি
দিতে বলা হয় চিঠিতে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই চিঠির শেষে বলা হয়,
“০২। বণিতাবস্থায়, সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের সুপারিশের আলোকে উপরিউল্লিখিত
কর্মকর্তাগণের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন জারি করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা
হলো।” জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই চিঠির স্মারক নম্বর- তারিখের
০৫.০০.০০০০.০০০.১৩৩. ১২.১০৩.২৪-১৬২। চিঠির ওপরে লেখা ছিল- “গোপনীয়” “অতি
জরুরি”।
দেখা যাচ্ছে যে, এর দু’দিন পরে ২১ মে খাদ্য মন্ত্রণালয়
শুধুমাত্র মো. আব্দুস সালামের পরিচালক পদে পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
প্রজ্ঞাপন জারির পর ওই দিনই মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আপলোডও করা হয়েছে।
কিন্তু একই চিঠির অন্য আরেকজন কর্মকর্তা, মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ খান শিবলীর
পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন ইতিমধ্যে আড়াই মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত
জারি করা হয়নি। যদিও একই সঙ্গে দু’জনেরই পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন জারি করাটা
অপরিহার্য ছিল।
প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদিত এসএসবির সুপারিশ অনুযায়ী
পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন জারি না করে এভাবে কারো পদোন্নতি আটকে রাখার ক্ষমতা
উপদেষ্টা বা সচিবের- এই দু’জনের কারোরই নেই। এটা তারা নিজেরাও জানেন।
উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার ইতিপূর্বে একই সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব (এসএসবির
সভাপতি) এবং মুখ্যসচিবের দায়িত্বও পালন করেছেন। সচিব মাসুদুল হাসান
প্রশাসন ক্যাডারেরই কর্মকর্তা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েও অতিরিক্ত সচিব
হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। বস্তুত, এরা দু’জন দুর্নীতি ও আখের গোছানোর
কাজে এতটা বেপরোয়া যে, সবকিছু জানা সত্ত্বেও নিয়ম-নীতির মোটেই তোয়াক্কা
করছেন না। বস্তুত, পরিচালক (পরিদর্শন, উন্নয়ন ও কারিগরি সেবা বিভাগ) পদে
চলতি দায়িত্বে তাজল ইসলামকে অবৈধভাবে বহাল রাখার জন্যই উপদেষ্টা ও সচিব এ
রকমের বেপরোয়া দুর্নীতি-অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র
জানিয়েছে।
এদিকে অধিদপ্তরের চলাচল, সংরক্ষণ ও সাইলো বিভাগের পরিচালক
(চ.দা.) পদে আছেন বর্তমানে জহিরুল ইসলাম খান। তাঁর বিরুদ্ধে
অনিয়ম-দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারি, অনাচারসহ অসংখ্য গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
জহিরুল ইসলামের স্ত্রী শারমিন আক্তার এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট লিখিত অভিযোগ
করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিবের কাছে পৃথকভাবে। শারমিন আক্তারের
লিখিত অভিযোগপত্রে দুর্নীতির কথাও উল্লেখ রয়েছে। সচিবের কাছে লিখিত
অভিযোগের আগে শারমিন আক্তার তার স্বামী জহিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে নারী
নির্যাতনের মামলাও দায়ের আদালতে। ওই ফোজদারি মামলার কপিসহ তিনি সচিবের কাছে
লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের ফৌজদারি মামলার কপিসহ
মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দায়ের করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা
কর্মচারীকে সাসপেন্ড করার কথা। এবং এরসঙ্গে তদন্ত কমিটি গঠন করারও নিয়ম
রয়েছে। তদন্তে তিনি দোষী সাব্যস্ত হলে বিভাগীয় মামলা দায়ের করে শাস্তিমূলক
ব্যবস্থা নেয়ার নিয়ম রয়েছে। একই সঙ্গে জহিরুল ইসলামের দুর্নীতির অভিযোগগুলো
তদন্তের জন্য দুদকে পাঠানোর নিয়ম রয়েছে। কিন্তু জহিরুল ইসলাম খানের
ক্ষেত্রে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সাসপেন্ডও করা হয়নি।
এসব ঘটনার
মধ্যেই দেখা গেলো, সাসপেন্ডসহ নানা রকমের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তে
জহিরুল ইসলাম খানকে অপকর্মের পুরষ্কার হিসেবে মন্ত্রণালয় উল্টো তাকে
পরিচালক (চ. দা) পদে পদোন্নতি দিয়েছে। গত ৩ আগস্ট জহিরুল ইসলামকে এই
পদোন্নতি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে বড় অংকের লেনদেন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র
জানিয়েছে।
এ জাতীয় আরো খবর..