প্রিন্ট এর তারিখঃ Oct 12, 2025 ইং || প্রকাশের তারিখঃ Sep 30, 2025 ইং
৩৪ বছরে প্রথম বার লোকসানের খাতায় ব্যাংক খাত

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেশের অন্যান্য খাতের মতো
ব্যাংকগুলোতে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। সেই লুটপাটের ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে এখন।
ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। মূলধন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে সংরক্ষণের
হার। একই সঙ্গে গড়ে ব্যাংক খাতের আয় স্মরণকালের সব রেকর্ড ভেঙে নিচে
নেমেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের লুটপাটের ফলে ৩৪ বছরের ইতিহাসে প্রথম বার
লোকসানের খাতায় নাম লেখালো ব্যাংক খাত।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর
পর্যন্ত ব্যাংকগুলো গড়ে লাভজনক অবস্থায় ছিল। কিন্তু গত মার্চে এসে গড়
হিসাবে লোকসানে চলে গেছে। আলোচ্য সময়ে সম্পদ ও মূলধন কোনো খাত থেকেই
ব্যাংকগুলোর গড়ে কোনো আয় হয়নি। বরং লোকসান হয়েছে। সম্পদ থেকে লোকসান হয়েছে
দশমিক ১৮ শতাংশ এবং মূলধন থেকে লোকসান হয়েছে ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ। টানা ৩৪ বছর
পর অর্থাৎ ১৯৯০ সালের পর ব্যাংক খাত গড়ে হিসাবে এই প্রথম লোকসানের খাতায়
নাম লিখিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া
গেছে।
আওয়ামী লীগের লুটপাটের প্রভাবে ২০১২ সাল থেকে ব্যাংক খাতে আয়
কমতে থাকে। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোটামুটি মুনাফায় থাকলেও ২০১৮ সালে
আয় কমে গিয়েছিল। এরপর ২০২১ ও ২০২২ সালেও নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত থাকে।
লুটেরা সরকার ২০২৩ ও ২০২৪ সালে কৃত্রিমভাবে মুনাফা দেখিয়ে ব্যাংক খাতকে
লাভজনক দেখায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯০ সালের
আগেও লুটপাটের কারণে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সরকারি ও বেসরকারি
খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকই তখন লোকসানি ছিল। এরপর ১৯৯১ সাল থেকে ব্যাংক খাতে
নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে লোকসানের পরিমাণ কমে
গড়ে লাভজনক অবস্থায় আসে ব্যাংকগুলো। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের হিসাবের
মারপ্যাঁচে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা ৩৪ বছর ব্যাংকগুলো গড়ে লাভজনক অবস্থায়
ছিল। ৩৪ বছর পর চলতি বছরের মার্চে এসে ব্যাংকগুলোয় গড় হিসাবে লোকসান দেখানো
হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, প্রতি বছরের প্রথম প্রান্তিক
পূর্ণ হয় মার্চ মাসে। এই প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর আয় কম হয়। বছর শেষে আয়
বাড়ে। যে কারণে অনেক সময় বছরের শুরুর দিকে ব্যাংকগুলো লোকসানে থাকে। কিন্ত এ
বছরের আগে মার্চ প্রান্তিকেও গড়ে লোকসান হয়নি। কম হলেও অনেক সময় গড়ে লাভ
দেখানো হয়েছে।
ব্যাংক খাত লোকসানের একমাত্র কারণ হিসাবে বিগত
সরকারের আমলে সংঘটিত লুটপাটকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকগুলো থেকে বিধিবিধান বহির্ভূত অনেক বড়
অঙ্কের ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। সেসব ঋণ এখন আদায় হচ্ছে না। যে কারণে অনাদায়ী
ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এমন ঋণ এখন খেলাপি হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোর আয়যোগ্য
সম্পদের পরিমাণ কমেছে। ফলে সার্বিকভাবে আয়ও কমে গেছে। অন্যদিকে বেড়েছে খরচ।
এসব কারণে ব্যাংকগুলো লোকসান দিচ্ছে।
গত সরকারের আমলে ব্যাংক খাত
থেকে প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছে লুটেরারা। এসব টাকার বড় অংশই
পাচার হয়েছে বিদেশে। যেগুলো আদায় হচ্ছে না, সেগুলো খেলাপি ঋণের খাতায়
যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ছিল এক লাখ
৮২ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এক বছরে
খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। এতে ব্যাংকগুলোর আয় কমছে।
ব্যাংকগুলোর
আয়ের প্রধান খাত হচ্ছে ঋণ বা বিনিয়োগ থেকে পাওয়া সুদ বা মুনাফা। এর বাইরে
সামান্য কিছু আয় হয় মূলধন বিনিয়োগ থেকে। যে কারণে সম্পদ থেকে আয় কমে গেলেই
তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর সম্পদ বা
বিতরণ করা ঋণ ও অন্যান্য সম্পদ থেকে আয় ছিল দশমিক ৪৩ শতাংশ। একই সময়ে মূলধন
থেকে আয় ছিল ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। খেলাপি ঋণ বাড়ায় গত মার্চে সম্পদ থেকে কোনো
আয় হয়নি। উলটো শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ লোকসান হয়েছে। মূলধন থেকেও আয় হয়নি।
উলটো লোকসান হয়েছে ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
জানা গেছে, ২০০৭ সালে তৎকালীন
তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিলে ব্যাংক খাতে ব্যাপক সংস্কার শুরু হয়। এর
ইতিবাচক প্রভাব পড়ে সার্বিক খাতটির ওপর। যার সুফল প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ
সরকারও পেয়েছিল। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগ সরকার লুটপাট শুরু করলে ক্রমেই
দুর্বল হতে থাকে ব্যাংক।
২০১১ সাল থেকে ব্যাংকগুলোর আয় কমতে থাকে।
ওই সময়ে ব্যাংক খাতে শুরু হয় লুটপাট। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংকগুলোর
আয়ের ওপর। সম্পদ ও মূলধন দুই খাত থেকেই আয় কমে যায়। সে বছরে সম্পদ থেকে আয়
আগের বছরের তুলনায় কমে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং মূলধন থেকে আয় ১৭ দশমিক ০২
শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১২ সালে আয় আরও কমে যায়। কারণ ওই বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে
বিভিন্ন পণ্যের দাম কমে যায়। ফলে বেশি দামে পণ্য আমদানি করে কম দামে
বিক্রি করতে বাধ্য হন অনেক ব্যবসায়ী। ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়
দ্বিগুণ। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংকগুলোর আয়ে।
© বরিশাল খবর সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত